top of page

এক তারকার নীরব প্রস্থান


অবসর নিলেন যুবরাজ সিংহ। ভারতের আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম তারকা । নীরবে, নিভৃতে ।অবসর নেয়ার জন্য কোন ফেয়ারওয়েল ম্যাচ পেলেন না। অভিমান ঝড়ে পড়লো ২০১১ বিশ্বকাপের ম্যান অফ দ্যা টুর্নামেন্টের গলায়। এরকম প্রস্থান কি প্রাপ্য ছিল যুবরাজের সিংহের, যিনি অজান্তে ক্যান্সার সংক্রমণ নিয়ে খেলে গিয়েছেন, একদিবসীয় ও কুড়ি-কুড়ি ক্রিকেটে ভারতকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন, অসংখ্য ম্যাচ জিতিয়েছেন, কঠিন পরিস্থিতি থেকে ভারতকে টেনে তুলেছেন?? সেই যুবরাজ যিনি তাঁর বাহারি স্ট্রোক প্লে দিয়ে মাত করেছিলেন জীবনের প্রথম ইংনিস, ভারতীয় মিডল-অর্ডারে সাবলীল ব্যাট হাতে রামধনু সৃষ্টি করত যাঁর স্ট্রোক প্লে?


মনে করুন সেই কঠিন সময়। ভারতীয় ক্রিকেটের সেই অন্ধকার সময়। ২০০০ সাল; বেটিং কাণ্ডে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন আজাহার, জাদেজা , মোঙ্গিয়ারা। গোটা ভারতে ক্রিকেটকে ঘিরে এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ। ঠিক তখনই ভারতীয় ক্রিকেট মঞ্চ বরণ করে নিয়েছিল যুবরাজ সিংহকে।জীবনের প্রথম ইনিংস স্টিভ ওয়ের প্রায় অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। অভিষেক কেনিয়ার সঙ্গে হলেও ব্যাট করার সুযোগ পান নি।ম্যাকগ্রা, লি, গিলেসপি, ওয়ার্ন নির্ভর অস্ট্রেলিয়া বোলিং-এ তখন বসন্ত। মারমুখী সচিনের পতনের পর খুব কম ব্যবধানে আরও ৪ উইকেটের পতন এবং দলগত রান একশো পেরবার আগেই যুবরাজের প্রবেশ। সাবলীল ভঙ্গিমায় অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের মত চাপহীন ব্যাট হাতে নকশী কাঁথার কারুকার্য সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। ৮০ বলে ৮৪ রান। ম্যাচ হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। তিনি ম্যান অফ দ্যি ম্যাচ। কিন্তু তাঁর ক্রিকেট জীবন চড়াই- উতরাই-এ ভরপুর। ২০০১-এ অফফর্মের জন্য বাদ পড়লেন যুবরাজ।আবার ফিরে এলেন নায়কের মত। ভারত-জিম্বাবুয়ে ওয়ান ডে সিরিজ। ভারত ৫ ম্যাচের সিরিজে ২-১ পিছিয়ে। এসেই সমতা ফেরালেন ব্যাট হাতে ঝলসে উঠা যুবরাজ। করলেন ৮০ (৬০ বলে); পরের ম্যাচেও ৭৫। এরপর ফর্ম আর অফফর্ম-এর মধ্য দিয়ে এগিয়েছে তাঁর ওয়ান ডে কেরিয়ার।


কিন্তু যুবরাজের প্রতিভা সম্পর্কে সবাই সুনিশ্চিত ছিলেন। ২০০২-এর ন্যাটওয়েস্ট ফাইনাল। তখন ভারত ফাইনালে গিয়ে হারাকে অভ্যাসে পরিণত করেছে। প্রথমে ব্যাট করে ৩২৫ রানের বিশাল রান খাড়া করে ইংল্যান্ড। ভারত আগ্রাসীভাবে শুরু করলেও পর পর উইকেট হারিয়ে চাপে পরে যায়। ১৪৬ রানে ৫ উইকেট। ক্রিজে দুই তরুন যুবরাজ এবং কাইফ। জেতার আশা প্রায় শেষ। এইসময় আবার নিজের জাত চেনান যুবরাজ। তাঁর লড়াকু ৬৯ ভারতকে জয়ের কাছাকছি পৌঁছে দেয়। এরপর যুবরাজ ক্রমশঃ এগিয়েছেন।খেলেছেন অসংখ্য ম্যাচ জেতানো ইংনিস। বল হাতে উইকেট তুলেছেন প্রয়োজনীয় মুহূর্তে। ২০০৩ বিশ্বকাপে দল ফাইনালে গেলেও সেরকম দাগ কাটা পারফরমেন্স করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু বিশ্বকাপের পরই জীবনের প্রথম শতরান করেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। সেই বছরেই ভারতীয় টেস্ট দলের জন্য বিবেচিত হন এবং নিজের ঘরের মাঠ মোহালিতে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট অভিষেক ঘটে তাঁর। অভিষেক ইনিংসে ২০ রান করেন তিনি। ২০০৪-এর শুরুর দিকে যুবরাজের শাসন শুরু হয়।অস্ট্রেলিয়ায় ত্রিদেশীয় সিরিজে ১২২ বলে ১৩৯ রানের অসাধারণ ইনিংস। তারপর পাকিস্থানের মাটিতে যুবরাজের বীরবিক্রম প্রদর্শনী প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির মাধ্যমে। ২০০৭ বিশ্বকাপে হতাশাজনক দলীয় পারফরম্যান্সেও কিন্তু উজ্জ্বল ছিলেন যুবরাজ। ২০০৭-এই ক্রিকেট বিশ্ব সাক্ষী হোল আধুনিকতম ক্রিকেটীয় সংস্করণ কুড়ি-কুড়ি বিশ্বকাপের। ধোনির নেতৃত্বে তরুন ভারতীয় দলের সহ-অধিনায়ক হলেন যুবরাজ সিংহ। সিংহ বিক্রমে ১ ওভারে ৬ বার স্টুয়ার্ট ব্রডকে মাঠের বাইরে পাঠান তিনি; ১২ বলে দ্রুততম পঞ্চাশ করার বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। প্রথমবার কুড়ি কুড়ি বিশ্বকাপ জেতে ভারত। আগ্রাসী ভূমিকা নেন যুবরাজ।


তবে অনেকবারই বিতর্কে জড়িয়ে ফর্ম হারিয়েছেন যুবরাজ সিংহ। ২০০৭-০৮ এক বিখ্যাত চিত্রতারকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন শোনা যায় । চূড়ান্ত অফফর্মে তিনি তখন। আবার নিজেকে সামলে নিয়ে ক্রিকেট মাঠকে শাসন করতে শুরু করেন তিনি। ২০১১ বিশ্বকাপে ব্যাটে-বলে ( ৩৬২ রান ও ১৫ উইকেট) দক্ষতা দেখিয়ে ভারতকে বিশ্বকাপ এনে দেন। বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের শিরোপা যায় তাঁর দখলে। কিন্তু সেই বছরেই ধরা পড়ে ক্যান্সার। অজান্তেই তিনি বিশ্বকাপে ক্যান্সারের যন্ত্রণা নিয়ে খেলছিলেন। বমি হত; ভাবতেন বোধহয় চাপ থেকে হচ্ছে। কিন্তু লড়াই ছাড়েন নি যুবরাজ।আবার ফিরে আসেন মাঠে। ২০১৪ সালের আইসিসি কুড়ি-কুড়ি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল । শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২১ বলে ১১। ম্যাচ হারে ভারত। সমালোচনায় বিদ্ধ হন যুবরাজ। ২০১৫-এর বিশ্বকাপে দল থেকে বাদও পড়েন। তবুও হার মানেন নি তিনি। ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ধোনিকে সঙ্গে নিয়ে ঝকঝকে ১৫০ রানের ইনিংস। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে পাকিস্থানের বিরুদ্ধে অনবদ্য ৫৩ রান। ২০১৭ সালে নিজের অজান্তে খেলে ফেলেন জীবনের শেষ ম্যাচ। আর অন্তিম টেস্ট ম্যাচ তারও অনেক অনেক আগে; ২০১২ সালে। শেষ কুড়ি-কুড়ি ম্যাচও খেলেন ২০১৭ তেই। আইপিএল খেলছিলেন; ২০১৮-১৯ কিছু ম্যাচে ভালোও খেলেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৯ বিশ্বকাপেও বাদ পড়েন যুবরাজ। তখনই স্থির করেন যে অবসর নেবেন।


বর্ণময় এক কেরিয়ারের বর্ণহীন বিদায়। টেস্টে নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেন নি যুবরাজ। নিজেও স্বীকার করেছেন তা। কিন্তু তবুও তাঁর অবদানকে মাথায় রেখে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড কি পারতো না একটি বিদায়ী ম্যাচের আয়োজন করতে? আসলে যুবরাজ সিংহ কোন অসন্মানজনক দরাদরি চান নি । নাম যুবরাজ হলেও তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল আপোষহীন সংগ্রাম। যুবরাজ ভারতের ক্রিকেটের রূপকথা - ব্যাটে, বলে এবং ফিল্ডিং-এ ।যুবরাজ যেন ভারতীয় ক্রিকেটের কর্ণ - যোদ্ধা, বীর; তবুও উপেক্ষিত ও অনাদৃত।যুবরাজের ক্রিকেট জীবন সেই তাঁর বিখ্যাত বিজ্ঞাপনের সংলাপের মত - "জব তক বল্লা চলেগা তবতক ঠাট রহেগা নেহি তো ..."। তবুও বলতে দ্বিধা নেই তাঁর এরকম নীরব প্রস্থান একবারেই কাম্য ছিল না। কেবল একটি বিদায়ী ম্যাচ। বহু ম্যাচ জেতানো নায়ক অবসরের নেওয়ার জন্য একটাও ম্যাচ পেলেন না। যুবরাজ সিংহ তাই কর্ণ ছাড়া আর কার সাথেই বা তুলনীয় হতে পারেন???

111 views0 comments
bottom of page