ভারতে বেকারত্বের হার বিগত সময়ের মধ্যে সর্বাধিক সীমায় পৌঁছিয়েছে এই সময়কালে। অসংখ্য বেকার ছেলেমেয়েদের ঘরে অন্ন জুটছে না চাকরির অভাবে দেশের সর্বত্র। বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে কর্মসংস্থানের এহেন খারাপ পরিস্থিতির আর সৃষ্টি হয় নি। লোকসভা নির্বাচনের আগে বারংবার সরকারের কাছে বেকারত্বের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করবার দাবি জানালেও, মোদী সরকার তখন এই বিষয়ে কোন কর্ণপাত করে নি। অথচ নির্বাচনের ঠিক পরেই এই তথ্য প্রকাশিত হওয়ার ফলে খুব সঙ্গত কারণেই এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে তাহলে কি মোদী সরকার নির্বাচনের আগে এই ভয়ানক বেকারত্বের তথ্য প্রকাশ করতে ভীত ছিল? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারা কি তবে উপলব্ধি করেছিলেন যে যদি এই ভয়ানক তথ্য নির্বাচনের আগে সর্বসমক্ষে চলে আসে, তাহলে হয়তো দ্বিতীয় দফায় আর মোদীর নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার আর গঠিত হবে না? আর তাই জনগণকে দেওয়া মিথ্যা প্রতিশ্রুতি যাতে প্রকাশ্যে না চলে আসে, সেই কারণেই গদি হারানোর ভয়ে ও আতঙ্কে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে মোদী সরকার বেকারত্বের এই ভয়ানক তথ্য প্রকাশ করে নি এবং সেই তথ্য অবশেষে প্রকাশিত হল গত ৩১শে মে, ২০১৯ তারিখে দ্বিতীয় দফার মোদী সরকারের প্রথম দিনে। সরকারের নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে ভারতে বেকারত্বের হার সর্বাধিক মাত্রায় পৌঁছিয়েছে মোদী সরকারের জমানায় এবং এই হার বর্তমানে গিয়ে পৌঁছিয়েছে ৬.১%-এ। এই তথ্যই এরপরে প্রকাশিত হয় বিভিন্ন Print এবং Electronic Media-তে।
লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধীদের ক্রমাগত দাবীকে উপেক্ষা করে যখন মোদী সরকার কোনওভাবেই বেকারত্ব সম্পর্কে কোন তথ্য হাজির করছিলো না, তখনই National Sample Survey Office (NSSO) থেকে কিছু তথ্য ফাঁস হয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমের হাতে পড়ে যায়। এই তথ্যকে সেই সময় কেন্দ্রীয় সরকার "Fraud Data" বলে উড়িয়ে দিলেও, আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে এখন সরকারের পক্ষ থেকে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তার সাথে নির্বাচনের আগে NSSO Leaked Data হুবহু মিলে যাচ্ছে। আসুন একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক নীচের সারণীতেঃ
সুতরাং এই প্রসঙ্গে সেইক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে তাহলে কি নির্বাচনের ফলাফলে কু-প্রভাবকে আটকানোর জন্যই কি তখন NSSO Leaked Data কে Fraud আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ?? একটু পিছনে ফিরে দেখলে আমাদের সকলেরই মনে পড়বে যে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচনী প্রচারগুলিতে সমগ্র ভারতবাসীর কাছে নরেন্দ্র মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কেন্দ্রে নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি থাকলে প্রতি বছরে দেশের দুই কোটি বেকার যুবক-যুবতীদের চাকরী হবে। কিন্তু বিগত ৩১শে মে, ২০১৯ তারিখে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা প্রকাশিত দেশের বেকারত্বের তথ্য কিন্তু সম্পূর্ণ তার উল্টো প্রমাণ দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা প্রকাশিত এই তথ্য আখেরে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে ২০১৪ সালের মোদীজীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আসলে একটি ভাঁওতাবাজী ছাড়া আর কিছু ছিল না। প্রতি বছরে দুই কোটি বেকারের চাকরীর বদলে বাস্তবে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বছরপ্রতি দেশের বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে গড়ে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার জন করে।
অবশ্য এই ভাঁওতাবাজীর রাজনীতিতে বাংলাও কোন অংশে পিছিয়ে নেই। গোটা দেশে যখন কর্মসংস্থানের এই ভয়ানক চিত্র উঠে আসছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ভাষণে জানিয়েছিলেন যে উনি নাকি এক বছরেই বাংলায় ২ লক্ষ সরকারী চাকরী আর ৮ লক্ষ বেসরকারী চাকরীর ব্যবস্থা করেছেন। অথচ যখন সারা দেশে বেকারত্বের হার আকাশ ছুঁয়েছে আর যেখানে বিগত আট বছরে রাজ্যে কোন নতুন শিল্পায়ন বা কলকারখানাই স্থাপিত হল না, তখন কিসের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রী এই ধরণের একটি তথ্য তাঁর ভাষণে উপস্থাপনা করেন, তা সহজেই বোধগম্য। আসলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে, মানুষকে মিথ্যা আশা প্রদান করে, ভুল বুঝিয়ে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে তৃণমূল কংগ্রেস। তার পরবর্তীতে গণতন্ত্রকে হত্যা করে প্রতিটি নির্বাচনে জয়লাভ করে গিয়েছে এরা এবং ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করেন মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তাই ক্ষমতা ধরে রাখতে একই সাথে পেশীশক্তির প্রদর্শন ও মিথ্যাচার - এই দুইকেই হাতিয়ার করতে চায় তারা। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ অনুযায়ী যদি সত্যিই এক বছরে বাংলায় ২ লক্ষ সরকারী চাকরী আর ৮ লক্ষ বেসরকারী চাকরী হত, তাহলে কি আদৌ সেই মুখ্যমন্ত্রীকেই কখনও বলতে হত বেকারত্ব ঘোচাতে "চপ শিল্প" প্রতিষ্ঠার কথা?? সিঙ্গুর থেকে টাটাদের ন্যানো প্রকল্প সরে যাওয়ার পরে এবং ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবার পরে আক্ষরিক অর্থেই এই বাংলায় এমন কোন নতুন শিল্পোদ্যোগ হয় নি, যার মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী বর্ণিত সংখ্যার চাকরী সৃষ্টি হতে পারে। ১০০ দিনের কাজ আর সিভিক ভলান্টিয়ার দিয়ে কি আর এই বাংলার বেকারত্ব ঘোচানো যায়?? অন্যদিকে কাটমানির ফাঁদে পড়ে বহু ১০০ দিনের কাজের টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। সিভিক ভলান্টিয়ারদের প্রাপ্য বেতন নিয়েও দীর্ঘ অভাব অভিযোগ রয়েছে।
বছর বছর ধরে কোচিং সেন্টারে বহু মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা টাকা খরচ করে তৈরী হয় রেলের পরীক্ষা দিয়ে রেলদপ্তরে সরকারী চাকরী পাওয়ার আশায়। কিন্তু বিগত পাঁচ বছর ধরে দেশের সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে আজ ভারতীয় রেল বিপদসীমার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভারতীয় রেলকে বিলগ্নীকরণ করে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর আজ মোদী সরকার। এমতাবস্থায় এটি কি আগামীদিনে আদৌ একটি সুরক্ষিত কর্মস্থল, এই প্রশ্নও কিন্তু লক্ষ লক্ষ যুবদের মনের মধ্যে ঘুরছে। আরো একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বি.এস.এন.এল-এর লক্ষাধিক কর্মচারীর বেতন আটকে রয়েছে দীর্ঘদিন। দেশের সরকারী চাকরীর পরিস্থিতিই যদি এমন হয়, তবে বেসরকারী চাকরীর অবস্থা যে কতটা সঙ্কটজনক, তা সহজেই অনুমেয়। ২০১৬ সালে মোদী সরকারের নেওয়া নোটবন্দীর সিদ্ধান্তের ফলে এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও কাঠামো নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। তার পরবর্তীতে দেশের বেকারত্ব ঘোচানোর জন্য সদর্থক কোন পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে একটির পরে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নীকরণ, ব্যাঙ্ক ও বীমার বেসরাকারীকরণ-এর মতন দেশ বেচে দেওয়ার প্রচেষ্টাই যে আসলে দেশের বেকারত্ব বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ, তার প্রমাণ কিন্তু আজ পাওয়া যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা প্রকাশিত দেশের বেকারত্ব সংক্রান্ত তথ্যের মাধ্যমে, যা গোটা বিশ্বের সামনে লজ্জাজনকভাবে তুলে ধরছে যে বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে ভারতে বেকারত্বের হার এখন সর্বাধিক।।
Commentaires