top of page
Writer's pictureঋতম পালিত

স্মরণে গিরীশ কারনাড

Updated: Jun 18, 2019

এবছর আরও এক নক্ষত্রের পতন হলো অভিনেতা গিরীশ রঘুনাথ কারনাডের জীবনাবসানের মধ্যে দিয়ে। গত ১০ই জুন, ২০১৯ তারিখে সকালে ব্যাঙ্গালুরুর বাড়িতে ৮১ বছর বয়সে পরলোক যাত্রা করেন।। অভিনেতা, নাট্যকার, সাহিত্যিক, চিত্র পরিচালক, ভাষা বিজ্ঞানী, অনুবাদক ও বিশিষ্ট বামপন্থী সমাজ চিন্তাবিদ হিসাবে অনেকের হৃদয়ে আজীবন স্মৃতি হয়ে থাকবেন।


তার প্রাথমিক পড়াশোনা কর্নাটকে হলেও অঙ্ক এবং সংখ্যাতত্ত্বে স্নাতক হওয়ার পর তিনি রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৭০ সালে কন্নড় ছবি ‘সংস্কার’ দিয়ে যাত্রা শুরু করেন কারনাড। টিভি সিরিজ ‘মালগুডি ডেজ’-এ অভিনয় করেন তিনি। ১৯৭১ সালে কন্নড় ছবি ‘বংশবৃক্ষ’-র হাত ধরে পরিচালক হিসেবে ডেবিউ করেন কারনাড। এ ছবির হাত ধরেই সেরা পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও পান তিনি। ১৯৭৪ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয় তাঁকে। ১৯৯২ সালে কারনাড পান পদ্মভূষণ।তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ছাড়াও সাহিত্যেকদের জন্য প্রদত্ত ভারতের সর্বোচ্চ সম্মননা জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও লাভ করেন।


ষাটের দশকের গোড়ার দিকে নাট্যকার হিসেবে প্রথম পরিচিতি লাভ করেন কারনাড। কন্নড় ভাষায় আধুনিক নাট্যকলার উত্থানের পাশাপাশি বাড়ে তাঁর জনপ্রিয়তা। এর পর দক্ষিণী সিনেমায় প্রবেশ, তারপর বলিউড। ১৯৯৮ সালে সাহিত্য এবং শিল্প জগতে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। কারনাডের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৯ মে, মহারাষ্ট্রের মাথেরানে।নিজের লেখা নাটকেরও ইংরেজি অনুবাদ করেন তিনি। এর মধ্যে বেশ কিছু নাটক বড় পর্দায় দেখা যায়, সৌজন্যে ইব্রাহিম আলকাজি, বি ভি করন্থ, অলীক পদমসি, প্রসন্ন, এবং অরবিন্দ গৌরের মতো চিত্র পরিচালক। কারনাডের নিজের পরিচালনায় শেষ ছবি কন্নড় ভাষায় ‘আপনা দেশ’, যা আগামি অগাস্ট মাসে মুক্তি পাওয়ার কথা। অভিনেতা হিসেবে তাঁর শেষ হিন্দি ছবি ২০১৭ সালের ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’, যেখানে তাঁকে দেখা যায় সলমন খান ও ক্যাটরিনা কাইফের সঙ্গে, ডাঃ শেনয়-এর ভূমিকায়।


পাগলা রাজা লোকে বলে তাঁকে। হিন্দু বিষ্ণুপ্রসাদের সম্পত্তি কিন্তু ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন মহম্মদ বিন তুঘলকই। কারণ তাঁর রাজত্বে হিন্দু-মুসলমান দ্বৈরথ তিনি চান না। জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর গিরীশ কারনাডের লেখা ‘তুঘলক’ নাটকের শুরুটা এরকমই। সেখানে মৃত্যুর কুড়ি বছরের মধ্যে লোকে তুঘলককে ভুলে যায়, অত্যাচারী বলে চিহ্নিত করে। আদর্শবাদ এবং জনজীবনে ফারাক বহু দূর! মাত্র ১৪ বছর বয়সে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন করনাড ৷ তাঁর লেখা পরে প্রশংসা করেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক টিএস এলিয়টও৷ কারনাডের লেখা মহাভারত বিষয়ক ‘যযাতি’ আলোড়ন ফেলেছিল সাহিত্য দুনিয়ায় ৷ এটি ছিল তাঁর লেখা দ্বিতীয় নাটক ৷


গিরীশ করনাডের লেখা সবচেয়ে চর্চিত লেখাগুলো হল, তুঘলক (১৯৬৪), হায়াবন্দনা (১৯৭২), অঞ্জুমাল্লিগে (১৯৭৭), তাল্লেডান্ডে (১৯৯০), আগি মত্তু মালে (১৯৯৫), তিপ্পুভিনা কানাসুগালু (১৯৯৭), ওদাকালু বিম্বা (২০০৫) ৷ তবে শুধুই নাট্যচর্চায় নয়, হিন্দি সিনেমাতেও তাঁর অবদান প্রচুর ৷ কন্নড় ছবি ‘সমস্করা’তে অভিনয়ের জন্য স্বণর্কমল সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছিল গিরীশ কারনাডকে৷ তবে শুধু সিনেমায় অভিনয় নয়, ছবি পরিচালনাতেও হাত রেখেছিলেন গিরীশ কারনাড৷ ‘উৎসব’ ও ‘গোধূলি’ এই দুটি হিন্দি ছবিও তৈরি করেছিলেন গিরীশ কারনাড৷ তবে শুধুই সাহিত্য চর্চা, সিনেমাতে নয়, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক, সামাজিক নানা ঘটনায় বারবার সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন গিরীশ কারনাড। সমাজের অনেক সমস্যা তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়। তাঁর নাটকে বারবার বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে। মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয় তাঁকে। নকশালদের উৎসাহ দিচ্ছেন, এই অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তবে শুধু ভারতের মঞ্চে নয়, বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশেও তাঁর কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।


তাঁর মা কৃষ্ণবাইয়ের মানিককার ছিলেন একজন যুবতী বিধবা, এবং একজন নার্সের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় তিনি বোম্বাই মেডিক্যাল সার্ভিসের একজন চিকিৎসক ডাঃ রঘুনাথ কর্নদকে দেখেন। বিধবা পুনর্বিবাহের বিরুদ্ধে চলমান বৈষম্যের কারণে পাঁচ বছর ধরে তারা বিয়ে করতে পারত না। অবশেষে তাদের বিবাহ আর্য সমাজের বিধানের অধীনে পবিত্র করা হয়েছিল। পরবর্তীতে জন্মগ্রহণকারী চার সন্তানের মধ্যে গিরীশ তৃতীয়।


গিরীশ কারনাডের মুখ ছিল, মুখোশ ছিল না। যা বিশ্বাস করতেন, সেটিই লিখতেন। কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশ হত্যার পরে নাকে পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। ‘নট ইন মাই নেম’, ‘আমিও শহুরে নকশাল’ বলে গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়েছিলেন। লোকসভা ভোটের আগে প্রায় ছ’শো থিয়েটার কর্মীর সঙ্গে একযোগে বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিজেপি জিতলে ভারত নামটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ধারণা এবং দেশের সংবিধান, দুইই বিপন্ন হবে। হিন্দু-মুসলিম সংহতির পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছেন বরাবর। নোবেলজয়ী লেখক ভি এস নয়পলের লেখায় মুসলিম বিদ্বেষের ছোঁয়া দেখে পরিষ্কার বলেছিলেন, ভারতের ইতিহাসে মুসলিম অবদান নিয়ে নয়পলের কোনও ধারণা নেই।


গিরীশের প্রতিবাদ মানে উচ্চকিত স্লোগান ছিল না। নম্র স্বরে প্রশ্ন তুলতেন। ‘রোডস স্কলারশিপ’ নিয়ে অক্সফোর্ডে পড়তে যাচ্ছেন, তার আগেই লিখে ফেললেন জীবনের প্রথম নাটক ‘যযাতি’। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে দেবযানীকে বিয়ে করেছেন যযাতি, তিনটি পুত্রও আছে। কিন্তু এক দিন মুগ্ধ হলেন দৈত্য রাজকন্যা শর্মিষ্ঠাকে দেখে। তাঁকে বিয়ে করলেন, শ্বশুর শুক্রাচার্য এসে অভিশাপ দিলেন। অভিশাপ কাটানোর উপায় একটিই। কোনও পুত্র যদি যযাতির জরা এবং বার্ধক্য গ্রহণ করে তাঁকে নিজের যৌবন দেয়! মহাভারতের এই গল্পটি বহু পরিচিত, বাংলায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যও আছে। গিরীশ সেই জানা গল্পটাই বলেন, কিন্তু সেখানে পুরুর বউ চিত্ররেখা এসে শ্বশুরকে প্রশ্ন করে, তার দাম্পত্য নষ্টের কী অধিকার যযাতির ছিল?


এই প্রশ্ন হতে পারে নারীবাদের। আবার দেখা যেতে পারে অন্য ভাবেও। ভারতীয় পরিবার মানেই বাবার ব্যর্থ স্বপ্নের ভার বইতে বইতে জরাগ্রস্ত হয়ে ক্ষয়ে যাবে পুত্র। এই যে মহাকাব্য, মিথ ও লোককথাকে ব্যবহার করে, তাকে আধুনিকতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া, এখানেই গিরিশের বৈশিষ্ট্য। ‘হয়বদন’, ‘রক্তকল্যাণ’, ‘নাগমণ্ডল’— একের পর এক নাটক। নাট্যকার হিসাবেই পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ থেকে জ্ঞানপীঠ!


বাঙালিও তো বারংবার মজেছে তাঁর নাট্যস্বপ্নকল্পে। চিত্তরঞ্জন ঘোষ থেকে শঙ্খ ঘোষ, স্বপন মজুমদাররা অনুবাদে গিরীশের নাটককে নিয়ে এসেছেন বাংলায়। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, অবন্তী চক্রবর্তীরা তাঁর নাটক করার জন্য অনুমতি চেয়েছেন, বিনা বাক্যব্যয়ে সম্মতি দিয়েছেন। এক পয়সাও নেননি। অবন্তী নিজের অনুবাদে ‘নাগমণ্ডলম’ করেছেন, প্রথম দিনের রিহার্সালেই হাজির তিনি!


সিনেমায় কন্নড় থেকে হিন্দি, অবাধ যাতায়াত তাঁর। ‘সংস্কার’, ‘আনন্দ ভৈরবী’, ‘উমবার্থা’ থেকে ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’, টিভি সিরিজ ‘মালগুড়ি ডেজ’ বা ‘ইন্দ্রধনুষ’ থেকে হাল আমলের ‘এক থা টাইগার’ সর্বত্র তাঁর অনায়াস উপস্থিতি। পরিচালনাতেও উজ্জ্বল ‘গোধূলি’ বা ‘উৎসব’-এর মতো ছবির সুবাদে।


উজ্জ্বল, কিন্তু সেলিব্রিটিসুলভ নয়। বেঙ্গালুরুর শ্মশানে গত ১০ই জুন ছাই হয়ে গেল তাঁর মরদেহ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সকলেই শোকবার্তা জানিয়েছেন। কর্নাটক সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য করতে চেয়েছিল। কারনাড পরিবার রাজি হয়নি। রাজসম্মান নয়, নাট্যকার হিসেবেই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন গিরীশ কারনাড।


ভারতে বামপন্থা ও বামপন্থী বিচারধারা অক্ষুন্ন রাখতে আরও গিরীশ কারনাডের যেন জন্ম হয় এই আশা আমরা রাখবো।।

127 views0 comments

Comments


bottom of page