গতকাল ১লা অক্টোবর, ২০১৯ তারিখে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কলকাতায় আসেন NRC নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মধ্যে একটি বিভেদকামী বিষ ছড়ানোর লক্ষ্যে। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে কিভাবে আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসামে গত ৩১শে আগস্ট, ২০১৯ তারিখে NRC-র চূড়ান্ত তালিকা বেরোনোর পরে ১৯ লক্ষের বেশী আসামবাসীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। গতকাল অমিত শাহ কলকাতার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে যে বক্তব্য রেখে গেলেন, তাতে একথা আজ আপামর পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে দিনের আলোর মতন পরিষ্কার যে ভারতীয় জনতা পার্টি এই NRC তথা NPR তথা NRIC Issue নিয়েই আগামী ২০২১ নির্বাচনে এই বাংলায় ক্ষমতায় আসতে চাইছে। এবং ক্ষমতা দখল করা ছাড়া আর অন্য কোন উদ্দেশ্যই যে BJP-র নেই সেটাও গতকাল স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, যখন দেখা গেল যে নিজের বক্তব্যে একবারের জন্যও অমিত শাহ আসামের নাগরিকপঞ্জীছুট মানুষদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করলেন না। খেয়াল করবেন যে আসামে NRC-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হওয়ার পরে ৩১টি দিন কেটে যাওয়ার পরেও না দেশের সরকার, না আসামের রাজ্য সরকার, না দেশের Supreme Court - এরা কেউ এখনও একবারের জন্যও বলে নি যে নাগরিকপঞ্জীছুট মানুষদের কোনোভাবেই কোন Detention Centre-এ পাঠানো হবে না। বরং অমিত শাহ গতকালকেও হুমকি দিয়েছেন যে সরকার নাকি সমস্ত অনুপ্রবেশকারীদের একজন একজন করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে
১| দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যখন আশ্বাস দিচ্ছেন যে NRC-র জন্য বাংলাদেশের উপরে কোন প্রভাব পড়বে না, ঠিক তখনই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ NRC করে লোকেদের দেশের বাইরে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছেন; তাহলে এই পরিস্থিতিতে আসামে নাগরিকপঞ্জীছুট ১৯ লক্ষ মানুষদের ভবিষ্যতের ঠিকানা কি হবে ??
বাংলাদেশ নাকি Detention Centre ??
নাকি হিটলারের Concentration Camp-এ ইহুদীদের যা পরিণতি হয়েছিল, তাই অপেক্ষা করে আছে এই মানুষগুলির জন্য ??
২| যদি নাগরিকপঞ্জীছুট মানুষদের দেশের বাইরে না পাঠিয়ে দেশের মধ্যেই Detention Centre-এ বন্দী রেখে দিতে হয়, তবে এই মানুষগুলিকে ভরণপোষণের জন্য যে কোটি কোটি অর্থের প্রয়োজন হবে, সেই অর্থ কোথা থেকে আসবে ??
দেশের উন্নয়ন আর বিকাশ না করে কেন দেশের মানুষের কষ্টার্জিত উপার্জনের টাকাকে অনর্থক কারণে অপচয় করা হবে ??
৩| গতকাল অমিত শাহ বলেছেন যে আগে নাকি CAB পাশ হবে, তারপরেই নাকি NRC চালু হবে। অথচ আসামে তো NRC চালু হয়েই গেল; কি ভরসা আছে যে পশ্চিমবঙ্গেও আসামের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না ??
৪| CAB-র মতন একটি অসাংবিধানিক এবং সাম্প্রদায়িক বিল আইনে পরিণত হওয়া ভারতের মতন একটি গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ দেশে সহজ নয়। তারপরেও যদি সংখ্যার জোরে এই বিল পাশ হয়ে আইনে পরিণত হয়েও যায়, এই বিলের সুবিধা আসামের নাগরিকপঞ্জীছুট হিন্দুরা কিভাবে পাবেন ??
কিভাবে তাঁরা অথবা পশ্চিমবঙ্গের কোটি কোটি উদ্বাস্তু বাঙাল পরিবাররা এই প্রমাণ দাখিল করবেন যে ১৯৪৭-এর পরে তাঁদের পরিবার ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে এই পশ্চিমবঙ্গ বা আসামে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন ??
আর এই প্রমাণ দাখিল না করতে পারলে যে তাঁরা শরণার্থী-র বদলে অনুপ্রবেশকারী-তে পরিণত হবেন, একথা তো আজ আসাম দেখে সকলেই বুঝতে পারছেন। তাহলে কি "মোশা" (মোদী-শাহ) আসলে NRC করে সমগ্র বাঙালী জাতিকেই ভারতীয় থেকে "অনুপ্রবেশকারী বিদেশী"-তে পরিণত করতে চাইছেন ??
গণতান্ত্রিক বিক্ষোভ প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-যুবদের অনৈতিকভাবে নয় ঘন্টা জেলবন্দী করে রাখবার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে Young Bengal-এর রাজ্য সম্পাদক তথা Joint Forum against NRC -র অন্যতম আহ্বায়ক দেবর্ষি চক্রবর্তী (Deborshi Azad) -এর প্রতিবাদী বক্তব্য শুনুন (https://www.facebook.com/JFANRC/videos/1118149648374824/)
আমরা জানি এই প্রশ্নের উত্তর "মোশা" থেকে আরম্ভ করে কোন রাজ্যস্তরের বিজেপি নেতা বা কোন NRC সমর্থক দিতে পারবেন না। আর তাই সামনাসামনি এই প্রশ্নের মুখেও তাঁরা পড়তে চান না। সেই কারণেই গতকাল যখন এই বাংলার কিছু প্রগতিশীল ছাত্র-যুবরা এই সহজ সরল প্রশ্নগুলি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে রাখতে চান তাঁর কলকাতা আগমনের সময়, তখন প্রশাসন সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে এই প্রতিবাদীদের গ্রেপ্তার করে এবং একটানা নয়-দশ ঘন্টা জেলে আটকে রাখে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রশাসনের এই স্বৈরাচারী পদক্ষেপ প্রমাণ করে দিল যে মুখে যতই বিরোধিতা থাকুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে এই রাজ্যে NRIC বা NPR চালুর প্রশ্নে রাজ্য প্রশাসন আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তের কোন সদর্থক বিরোধিতা করতেই চায় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যদি সত্যি করেই বাংলায় নাগরিকপঞ্জী করে বাঙালীকে অনুপ্রবেশকারী বানানোর চক্রান্তের বিরোধিতা করতে চাইতো, তাহলে গতকাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বিভেদমূলক প্রচারটাকেই আটকে দিতে পারতো। কিন্তু তা না করে "মা-মাটি-মানুষ"-এর সরকার গতকাল যে ভাবে প্রতিবাদী ছাত্র-যুবদের আটক করে রাখলো, তাতে একথাও আজ স্পষ্ট যে নিজেদের গদি বাঁচানোর জন্য এখন তৃণমূল কংগ্রেস প্রয়োজনে BJP-র সাথে NRC প্রশ্নেও আপোষ করতে রাজী।
তাছাড়া ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইন, যে আইনের বলে বলীয়ান হয়ে আজ দেশের ফ্যাসিস্ট সরকার এই বাংলায় NPR করতে চাইছে, সেই আইন সংসদে পাশ হওয়ার সময় আজকের মাননীয়ার কি ভূমিকা ছিল, তা আমরা সকলেই জানি। আর তাই NPR কে Census বলে গুলিয়ে দেওয়ার যে ঘৃণ্য পরিকল্পনা এই রাজ্যের সরকার করছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে শুধু একথাই বলবার যে আপনি যদি ভেবে থাকেন যে এই সস্তার আপোষের রাজনীতি করে বাংলার কোটি কোটি মানুষের মাথার উপরে নাগরিকপঞ্জীর খাঁড়াকে ঝুলিয়ে আর মুখে ছদ্ম BJP-বিরোধিতা করে আপনি আপনার গদি বাঁচিয়ে নেবেন, তাহলে আপনি কিন্তু মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। ভুলে যাবেন না এই বাংলাই কিন্তু একদিন সত্তরের দশকের কংগ্রেসের অপরাধের চরম শাস্তি দিয়েছিল চিরতরে কংগ্রেসকে বাংলার রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক বানিয়ে দিয়ে; এই বাংলাই আবার পূর্বতন বাম সরকারের বিভিন্ন অন্যায়-অবিচারের জবাব সজোরে ফিরিয়ে দিয়েছিল ৩৪ বছরের পরে তাদেরকে সমূলে উৎখাত করে। তাই মাননীয়া আপনি যদি সস্তার রাজনীতি করে বাংলার মেহনতী জনতাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন, বাংলার মেহনতী জনতা কিন্তু সেই হিসাব সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেবে ।।
Comments